শহরের যান্ত্রিক কোলাহলে যখন জীবন থমকে আসে, তখন মন চায় মুক্ত আকাশ, সবুজে ঘেরা পাহাড়, আর কিছু পাগলামী । ঠিক তেমন এক মুহূর্তেই আমরা সাত বন্ধু — আমি (জ্যোতি), সালমান, ইমন, নিশান, সুজন, তারিফ আর সম্রাট — সিদ্ধান্ত নিই, এবার পাহাড় ডাকছে। গন্তব্য: বান্দরবান ।
প্ল্যানটা এক মাস ধরে হচ্ছিল । ফেসবুক পোস্টে বান্দরবানের মেঘে ঢাকা ছবিগুলো দেখে আমাদের মনে আগুন জ্বলে উঠেছিল । বাইক চালিয়ে পাহাড়ে যাওয়া – এটা আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ।
শহরের একঘেয়ে জীবন আর চাকরির চাপ থেকে একটু মুক্তি পেতেই প্ল্যানটা প্রথমে মাথায় আসে সালমানের । আমাদের সাত বন্ধু—সবারই একটা জিনিস কমন: অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ । তবে এমন বড় ট্যুর অনেক দিন করা হয়নি ।
“চল বান্দরবান যাই, বাইকে। পাহাড় ডাকে!”—সালমানের কথায় বাকিরা আর না করতে পারেনি।
অনেক দিন আগে থেকেই পরিকল্পনা চলল, কে কী আনবে, কোন বাইক যাবে, স্পেয়ার পার্টস, তাঁবু, খাবার, ওষুধ—সবকিছুর তালিকা হলো ।
যাত্রার দিন ঢাকার পড়ন্ত বিকেলের রাস্তায় সাতটা বাইক একসঙ্গে যখন বের হলো, তখন যেন পুরো শহর তাকিয়ে দেখল।
রাস্তায় প্রথমেই একটা চা-স্টলে বিরতি। চায়ের কাপে প্রথম হাসি, প্রথম ক্লিক । এরপর একটানা চলা—কখনো রাস্তার পাশে সবুজ ধানক্ষেত, কখনো ছোট নদী । বাইকের গতি, হাওয়ার ছোঁয়া আর পেছনে ফেলে আসা শহরের স্মৃতি মিলিয়ে তৈরি হচ্ছিল এক নতুন রোমাঞ্চ ।
ঝরঝরে এক রাস্তায় নিশানের বাইক হঠাৎ পিছলে যায় । কিন্তু গুরুতর কিছু না । সবারই মোটামুটি থমকে যাওয়ার মত অবস্থা মুহূর্তেই বোঝা যায়, বন্ধুত্ব মানে বিপদে পাশে থাকা । কারও মুখে কোনো অভিযোগ নেই, শুধু চিন্তা—কীভাবে ভালোভাবে পৌঁছানো যায়।
চট্টগ্রাম পেরিয়ে বান্দরবানের দিকে ঘোরার সময় প্রকৃতি যেন বদলে যেতে লাগল । পাহাড়ের শুরু, বাতাসে ঠাণ্ডার ছোঁয়া, চারপাশে সবুজ আর উঁচুনিচু পথ । প্রথমবার কেউ যখন বাইকে পাহাড়ে উঠে, হৃদস্পন্দন যেমন বাড়ে, ঠিক তেমনই বাড়ছিল সবার উত্তেজনা ।
রাত আনুমানিক ১১ টা থেকে ১২ নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই বান্দরবান শহরে এবং প্রথম রাতটা কাটাই আমরা একটি হোটেলে সবাই নির্ঘুম রাত জেগে আনন্দ, হাসি, ঠাট্টা করে ।
পরদিন সূর্যোদয় আর নতুন চ্যালেঞ্জ আমাদের গন্তব্য নির্ধারণ হয় থানচি হয়ে ডিম পাহাড়ে যাব । রাস্তাটা সরু, আর একপাশে গভীর খাদ । তবু কারো চোখে ভয় নেই, আছে বিস্ময় । পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে যেন মনে হয় পৃথিবী থেমে গেছে । মেঘগুলো এত কাছে যে মনে হয় হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যাবে ।
হঠাৎ সুজন আর ইমন বলে ওঠে, “জীবনটা যদি এমনই হতো, না থাকতো অফিস, না থাকতো দুশ্চিন্তা, শুধু এমন পাহাড়, আর আমরা সাতজন!”
সবাই চুপ । কেউ কিছু বলে না । হয়তো বলে দেয়ার মতো কিছু ছিল না, শুধু অনুভব ছিল।
আমরা সেদিনই থানচি হয়ে তমা তুঙ্গী ঘুরে ডিম পাহাড়ে এক অ্যাডভেঞ্চার যাত্রা শুরু করলাম । রাস্তার সবুজ প্রকৃতি অনুভব করতে করতে আমরা সবাই ডিম পাহাড়ে পৌঁছে যাই । ডিম পাহাড়ে পৌঁছে সবার মাঝে যেন এক রক্ত গরম উত্তেজনা । সন্ধ্যায় আগুন জ্বালিয়ে সবাই বসে পড়লাম পুরনো দিনের স্মৃতি, প্রথম প্রেম, প্রথম হারানো কিছু নিয়ে । চারিদিকে পাহাড়ের নীরবতা ।
তারার নিচে তাবু টাঙিয়ে পাহাড়ের চূড়া থেকে ছোট্ট থানচি শহরটাকে সবাই চোখ জুড়িয়ে দেখতে লাগলাম ।
রাতের খাবার ছিল সিম্পল—পরোটা সবজি আর সালমান ভাইয়ের মুরগি বারবিকিউ । তবু সবাই খায় মন ভরে । রাত বাড়ে, আকাশে তারা ঝিকিমিকি করে। শহরের মতো আলো নেই এখানে, তাই আকাশটা যেন আরও বড়, আরও সুন্দর।
ভোরে সবাই উঠে সূর্যোদয় দেখে । লালচে আলো পাহাড়ের চূড়ায় পড়তেই মনে হয় যেন স্বর্গ নেমে এসেছে । ছবি তোলা, ভিডিও করা, হাসি আর ছোটাছুটি—সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ সময় ।
চার দিন পর শহরে ফিরে আসার সময় সবার মন ভার । কারো মুখে আগের সেই উচ্ছ্বাস নেই । পাহাড় যেন কিছু রেখে দিয়েছে সবার মনের ভিতরে । সবাই নিজে নিজে চুপচাপ চালিয়ে যাচ্ছে বাইক, মাঝে মাঝে চোখ যায় পাহাড়ের দিকে ।
ঢাকায় ফিরে আসার পর একে অপরের সাথে ছবি আদান প্রদান গল্প আড্ডা সবই হয় কিন্তু স্মৃতিটুকু থেকে যায় ।
ইমন বলে, “এডভেঞ্চার শেষ হয়নি । এ তো শুরু মাত্র।”
নিশান জবাব দেয়, “আরো পাহাড় আছে, আরো পথ আছে । আমরা তো আছি, আর আমাদের বাইক!”
—
উপসংহার :
সাত বন্ধু, সাতটা বাইক আর পাহাড়ের ডাক—এই তিনেই গাঁথা এক স্মরণীয় অভিযানের গল্প । এই এডভেঞ্চার শুধু পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোর নয়, ছিল বন্ধুত্ব, দায়িত্ব, সাহস, বিপদের মুহূর্তে পাশে থাকার চিত্র । জীবন একটাই, আর যদি তা অ্যাডভেঞ্চারহীন হয়, তবে বেঁচে থাকাই বৃথা ।
সেই পাহাড় আজও ডাকে, হয়তো নতুন কোনো বন্ধুদের জন্য।