ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি বছরের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন— ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ভারতের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে।

অতীতে এই দুই নেতা একে অপরের জন্য প্রচারও করেছেন, একসঙ্গে জনসভায় অংশ নিয়েছেন, নিজ নিজ বন্ধুত্বের বার্তা দিয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে মোদি প্রথম বিশ্বনেতা হিসেবে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে হোয়াইট হাউস সফরও করেন।

তবে মাত্র ছয় মাসের মাথায় বাস্তবতা বদলে গেছে। রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ভারতকে ২৫ শতাংশ শুল্কে দণ্ডিত করেছেন ট্রাম্প, যা আরও বাড়ানোর হুমকি দিচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তিও অনিশ্চিত, যা দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি করেছে।

ভারতের অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ বিস্বজিৎ ধর বলেন, “গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে পৌঁছেছে।”

ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে ভারত বরাবরই চাপের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে ভারতকে তার বাজার খুলতে, শুল্ক কমাতে এবং আমেরিকার প্রযুক্তি, ফার্মা ও কৃষি পণ্যগুলোর জন্য সুরক্ষা দিতে চাপ দিয়েছে।

কিন্তু ভারত দেখছে, এই ধরনের পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ শিল্প ও ক্ষুদ্র কৃষকদের বিপদে ফেলবে। অতীতেও সম্পর্ক অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল: ভারত একদিকে আমেরিকায় দ্বিগুণ রপ্তানি করতো, অন্যদিকে আমেরিকার পণ্যগুলো ভারতীয় বাজারে প্রবেশের সুবিধা পেয়েছে।

এপ্রিলে ট্রাম্প প্রায় সব বাণিজ্য সহযোগীর ওপর শুল্কের হুমকি দেওয়ার পর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি চুক্তি করতে চাইলেও ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণ, তথ্য সুরক্ষা ও মেডিকেল ডিভাইসের দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতবিরোধ চুক্তিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

১ আগস্ট সময়সীমাকে সামনে রেখে তৎপরতা বাড়লেও এবং কিছু অগ্রগতি হলেও সম্পূর্ণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এখনও হয়নি। বর্তমানে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন এবং রাশিয়ার তেল ও অস্ত্র ক্রয়ে আরও জরিমানা আরোপ করার হুমকি দিচ্ছেন।

ভারতের সাবেক কূটনিতিক অনিল ত্রিগুনায়েত বলেন, “এটা ট্রাম্পের চাপের কৌশল। ভারত এমন চাপে দমে যাবে না, কারণ আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও কৃষকদের রক্ষা করতে হবে।”

মূলত যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশ, এমনকি পাকিস্তান ও বাংলাদেশও কম শুল্কে পণ্য রপ্তানি করছে, ভারত পড়েছে উচ্চ শুল্কের মুখে। গত শনিবার এক জনসভায় মোদি বলেন, “বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা চলছে। এখন যা কিনব, তা ভারতীয় শ্রম ও ঘামের ফল হওয়া উচিত।”

রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার মূল কারণগুলোর একটি ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প চাপ প্রয়োগ করতে চাইছেন। এ অবস্থায় ভারতের রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও অস্ত্র কেনা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষোভের কারণ হয়েছে।

২০২৪ সালে পুতিন মোদিকে রাশিয়ার সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক “অর্ডার অব সেন্ট অ্যান্ড্রু” দেন। রাশিয়া ভারতের অন্যতম বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। সেইসঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভারতের রাশিয়ান তেল কেনাও বেড়েছে।

কাশ্মির যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের দাবি

চলতি বছরের এপ্রিলের এক হামলায় কাশ্মিরের পেহেলগামে ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তান বড় ধরনের সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এরপর মে মাসে ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি উভয় দেশকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়েছেন, নইলে বাণিজ্য বন্ধ করে দিতেন।

ভারত বলছে, যুদ্ধবিরতির পেছনে কোনো তৃতীয় পক্ষ নয়, তারা নিজেরাই সমঝোতায় পৌঁছায়। মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে ওই সময় কোনো কথা বলেননি বলেও দাবি করে দিল্লি। কিন্তু ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, তিনিই যুদ্ধ থামিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা

যুদ্ধবিরতির পর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে আমন্ত্রণ জানান। এটি ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। পরদিন ট্রাম্প মোদিকে “চমৎকার মানুষ” বললেও মুনিরকে যুদ্ধ থামানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী বলে উল্লেখ করেন।

ট্রাম্প বলেন, “আমি পাকিস্তানকে ভালোবাসি” এবং দাবি করেন, “আমি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ থামিয়েছি।”

অভিবাসন ও প্রযুক্তি খাতে ভারতীয়দের ওপর চাপ

মার্কিন সেনারা ভারতীয় অভিবাসীদের হাতকড়া পরিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর ভিডিও প্রকাশ্যে এলে ভারতে ক্ষোভ তৈরি হয়। ট্রাম্প প্রশাসন এই ইস্যুকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করছে।

এছাড়া প্রযুক্তি খাতে ভারতীয়দের নিয়োগ নিয়েও ট্রাম্প কড়া অবস্থানে রয়েছেন। ওয়াশিংটনে এক সম্মেলনে তিনি বলেন, “ভারতের কর্মীদের নিয়োগের দিন শেষ।”

ট্রাম্পের অভিযোগ: ভারত যুদ্ধের অর্থ যোগাচ্ছে

ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, ভারত রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে তেল কিনে সেটি বাজারে বিক্রি করে লাভ করছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে।

হোয়াইট হাউসের উপপ্রধান স্টিফেন মিলার বলেন, “ভারত এখন চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা। এটা বিস্ময়কর।”

ভারতের প্রতিক্রিয়া

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের মন্তব্যকে “অযৌক্তিক ও অন্যায্য” বলে নাকচ করে। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দ্বিচারিতা তুলে ধরে বলেছে, তারাও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এখনো রাশিয়া থেকে রাসায়নিক ও সার আমদানি করে।

ভারত রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এর সম্ভাবনা খুবই কম। ভারত স্বাধীনতার পর থেকেই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে।

মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “ট্রাম্প ভারতকে রাশিয়া ও ব্রিকস থেকে দূরে রাখতে চাপ দিচ্ছেন, কিন্তু ভারত এর বিপরীতে আরও কঠোরভাবে নিজের অবস্থানে অনড় থাকবে।”

ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এখন রাশিয়া সফরে আছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করও চলতি মাসের শেষ দিকে যাবেন। পুতিনও এ বছর ভারতে আসবেন বলে নিশ্চিত হয়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন?

বিস্বজিৎ ধর ও মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ক দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। কুগেলম্যান বলেন, “ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টাকে শাস্তি দিচ্ছেন, যা বাইডেন প্রশাসন করেনি।”

সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়েত বলেন, “বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন এখন আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

দীর্ঘমেয়াদে ভারত আশা করবে ট্রাম্পের ক্ষোভ কেটে যাবে— যদি রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করে। কুগেলম্যান বলেন, “এ কারণে ভারত রাশিয়াকে যুদ্ধ বন্ধে চাপ দেওয়ার চেষ্টা বাড়াতে পারে, কারণ এখন ট্রাম্প পুতিনের ওপর থাকা ক্ষোভ ভারতের ওপর ঢালছেন।”

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version