জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে চলমান সংলাপের মাধ্যমে তৈরি হওয়া জুলাই সনদের খসড়ার ভূমিকা ও উপসংহার রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হয়েছে। সনদের এ দুই অংশে বড় ধরনের কোনো আপত্তি নেই রাজনৈতিক দলগুলোর। তবে, কিছু আপত্তি রয়েছে এনসিপি ও জামায়াতের। কী কী বিষয়ে আপত্তি সেটি তারা কমিশনকে লিখিতভাবে জানাবে।
দলগুলোর দায়িত্বশীলরা বলছেন, কমিশন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া খসড়ায় ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো পরে যুক্ত করে দেওয়া হবে বলা হয়েছে। এখন কেবল খসড়া সনদের ভূমিকা ও উপসংহারের অংশ দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর ব্যাপারে মতামত আগামীকাল বুধবার লিখিতভাবে কমিশনে জমা দেবেন তারা।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ বিরতির সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন, জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়নকারী জোনায়েদ সাকি, নির্বাহী সমন্বয়ক আবুল হাসান রুবেল, এবি পার্টির প্রধান মুজিবুর রহমান মঞ্জু, বিএলডিপির চেয়ারম্যান ও ১১ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম।
এনসিপির জাভেদ রাসিন বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা নির্বাচনের আগেই আইনগত ভিত্তি পেতে হবে এবং সেই ভিত্তিতে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হতে হবে।
তিনি বলেন, এ দাবিতে প্রয়োজনে লিখিত অবস্থান জানাবে তাদের দল।
জাভেদ রাসিন অভিযোগ করেন, কমিশন ছয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির কথা বললেও তা নিয়ে আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ করে জুলাই সনদের খসড়া প্রকাশ করেছে, যা আমরা ‘সঠিক কাজ’ মনে করি না। এভাবে একতরফাভাবে কিছু চাপিয়ে দিলে তা আমরা মানি না।
কেয়ারটেকার সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় ‘র্যাংক চয়েস ভোটিং’ পদ্ধতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে নাগরিক পার্টি। জাভেদ রাসিন বলেন, আজ বিচার বিভাগ থেকে আরও দুই সদস্য যুক্ত করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব এসেছে যারা ভোট দেবেন। আমরা এই প্রস্তাবে একমত হয়েছি। প্রায় সব রাজনৈতিক দল একমত, কেবল বিএনপি ও কিছু সহযোগী দল ছাড়া।
তিনি আরও বলেন, দলটির ফোরামে আলোচনা করেই জুলাই সনদে সই করা হবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের স্পষ্ট অবস্থান—আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতির পর কমিশনের আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, আগের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় সাবেক বিচারপতিকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাখার বিধান ছিল, যা বর্তমান প্রস্তাবে বাতিল করা হয়েছে। এবার একটি রাজনৈতিক বাছাই কমিটি—প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি—মিলে প্রার্থী বাছাই করবেন।
যদি ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব না হয়, তাহলে ‘র্যাংক চয়েস ভোটিং’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিধান থাকছে। এ প্রক্রিয়ায় উপরের পাঁচজনের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন করে বিচারপতি যুক্ত হয়ে মোট সাতজন সদস্য ভোটে অংশ নেবেন। এই বিচারপতিরা নিজ থেকে কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবেন না—তারা শুধু ভোট দেবেন।
আখতার হোসেন বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এই পদ্ধতি সংসদে সরাসরি পাঠানোর চেয়ে কার্যকর। কারণ সেখানে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন হবে।
বিএনপির প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা বলেছে বাছাই কমিটি একমত না হলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো যেতে পারে।
আখতার হোসেন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি এই ফোরামেই সম্পূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। তা না হলে বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার দিকে যাবে।
জুলাই সনদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি এখনো একটি খসড়া এবং দলীয়ভাবে তারা তা পর্যালোচনা করছেন। এই খসড়ায় আমরা মৌলিক সংস্কারের প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত দেখতে চাই। যদি তা বাদ দেওয়া হয়, তাহলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে—সই করব কি না।
আখতার বলেন, আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে তারা ‘লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। একই সঙ্গে, যে সংস্কারগুলো রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে মেনে নিচ্ছে, তা যেন পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসা কোনো দল উপেক্ষা করতে না পারে—এই নিশ্চয়তাও চান তারা।
সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবও আসে তার বক্তব্যে। আখতার বলেন, যদি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান পুনর্লিখন করা যায়, তাহলে সেগুলো সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। আর এই সংস্কারগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন যেন ভবিষ্যতে প্রণীত না হয়—সে নিশ্চয়তার বিধান রাখার প্রস্তাবও দিয়েছি।
সংলাপের শেষ দিকে তিনি বলেন, আমরা চাই, মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে যত দ্রুত সম্ভব এই সনদ বাস্তবায়নের পথে যাওয়া হোক। দীর্ঘমেয়াদি বিতর্ক বা জটিলতায় আমরা যেতে চাই না।
আখতার হোসেন আরও বলেন, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে খুব শিগগিরই জুলাই সনদ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক বক্তব্য কমিশনে জমা দেওয়া হবে এবং পরে তা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরা হবে।
জামায়াতের বক্তব্য
জামায়াত নেতা তাহের বলেন, আমরা একমত হয়েছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই হতে হবে। প্রায় সবাই একমত, একমাত্র বিএনপি কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে—প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। এরা ১২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্য থেকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান নির্বাচন করবেন। একমত না হলে র্যাংক চয়েস ভোটিংয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। ভোটার হবেন মোট সাতজন—উল্লিখিত পাঁচজনের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের একজন করে বিচারপতি।
বিচারপতিরা যুক্ত হওয়ায় হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কা কমবে বলে মন্তব্য করেন তাহের।
তিনি বলেন, বিএনপি প্রস্তাব করেছে—ঐকমত্য না হলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো হোক। তবে জামায়াতসহ অধিকাংশ দল মনে করে, তা হলে সিদ্ধান্ত আর হবে না।
তিনি বলেন, সংসদে পাঁচ-ছয়টা দল আছে, অথচ এই বডিতে ৩০টির বেশি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
তাহের আরও বলেন, জামায়াত নিজস্ব একটি সনদের খসড়া তৈরি করছে এবং তা কমিশনে জমা দেবে।
জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে তিনি বলেন, এটি অসম্পূর্ণ এবং কিছু অংশ বিপজ্জনক। যদি এটা শুধু নমুনা হয় তাহলে মন্তব্যের দরকার নেই। কিন্তু যদি এটিই চূড়ান্ত হয় তাহলে আমরা তা মেনে নিতে পারি না।
‘আইনি কাঠামো গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াত দুটি বিকল্প প্রস্তাব করেছে। তা হলো- অধ্যাদেশের মাধ্যমে কাঠামো তৈরি করে পরে সংসদের অনুমোদন নেওয়া এবং গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া।’
আমরা চাই যেকোনো একটি পদ্ধতিতে কাঠামোটিকে আইনগত বৈধতা দেওয়া হোক। সংলাপ কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক না হলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ‘অনিশ্চিত’ হয়ে পড়বে বলেও সতর্ক করেন তাহের।
জোনায়েদ সাকির মত
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়নকারী জোনায়েদ সাকি বলেন, জুলাই সনদের এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু, উচ্চকক্ষ, পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলেও আমরা ঐকমত্য হতে পারিনি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি। আশা করছি, আমরা যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি, কমিশন জুলাই সনদে সেই বিষয়গুলো যুক্ত করবেন।
তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিগত ৪ দিন আলোচনা হলেও এখন ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। প্রথম জায়গাটি ছিল- বাছাই কমিটি করা। বাছাই কমিটি যদি সর্বসম্মত হতে না পারলে র্যাংক চয়েস পদ্ধতি করা। সেখানে গণসংহতি আন্দোলনের নতুন প্রস্তাব হচ্ছে- ৫ সদস্যের যে বাছাই হবে, সেখানে বিচারবিভাগ থেকে একজন প্রতিনিধি রাখা।
দলটির নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে আমাদের কিছু মতামত আছে, সেই বিষয়গুলো আগামীকাল আমরা কমিশনে জানাবো। আমাদের মনে হয়েছে, সনদের ভূমিকার কিছু শব্দ ও ভাষা আরও পরিচালিত করা দরকার। আরও কিছু বিষয় যুক্ত হতে পারে।
এবি পার্টির অবস্থান
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গ টেনে এবি পার্টির প্রধান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, বিতর্কমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও প্র্যাকটিস করতে না পারলে গণতন্ত্র আবার হুমকিতে পড়বে।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে কমিশনের প্রস্তাবে বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টতা ত্রয়োদশ সংশোধনীর প্রত্যাবর্তনের প্রাথমিক ধাপ আকারে রূপ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতির প্রবর্তন হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বিএলডিপির বক্তব্য
বিএলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, তত্ত্বাবধায়কের প্রধান উপদেষ্টা বাছায়ে ৫ সদস্যের কমিটি হয়েছে, সেই কমিটি নিয়ে আমাদের ঐকমত্য আছে। কিন্তু বাছাই কমিটি যে নাম সংগ্রহ করবে বিভিন্ন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে, সেখানে আমাদের আপত্তি হচ্ছে অনেক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নেই, আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের কোনো অবদান নেই। তাই এখানে শুধু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল থেকে নাম সংগ্রহ করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, কমিশনের আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে- বাছাই কমিটি ৫ সদস্যদের মধ্যে কোনও ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়কের প্রধান উপদেষ্টা করার ক্ষেত্রে ৪ জন একমত হতে হবে। সেখানে আমরা বলেছি, বাংলাদেশর বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা অসম্ভব। সেখানে ৩ জন্য ঐকমত্য হলে চলবে।